আ, ফ, ম, ইকবাল
করিমগঞ্জ, আসাম
কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে টাকাপয়সা রোজগার করে স্বাচ্ছন্দ্যের সামগ্রী যোগাড় করা যেতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের শান্তি এবং পরিতৃপ্তি নয়। গাড়িবাড়ি দালানকোঠা ইত্যাদি জীবনের জন্য হয়তো প্রয়োজনীয়, কিন্তু হৃদয়ের শান্তির জন্য চাই মানসিক পরিতৃপ্তি। তাই তো দেখা যায় কেউ সম্পত্তির পাহাড় গড়েও জীবনে চরম অতৃপ্ত। বিষাদগ্রস্ত। আবার কেউ আছে যারা শ্রম আর সাধনা দিয়ে গড়ে তোলা সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে হয় পরিতৃপ্ত। এর নাম ভক্তি। কখনও পুন্য কামনায়, কখনও সর্বজন হিতায়।
আগরতলা শহরের শিবনগরে অবস্থিত গেদুমিয়া মসজিদ হচ্ছে ভক্তি এবং শৈল্পিক সমন্বয়ে গড়ে উঠাএক অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন পরিকাঠামো। একেবারে ধুলোমাখা পথ থেকে নিজের অক্লান্ত শ্রম, অধ্যবসায় এবং সাধনার জোরে জীবনে সাফল্য ও কৃতকার্যতার চুড়ায় পৌঁছুতে সক্ষম হয়ে উঠা এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবদুল বারিক খান, ওরফে গেদু মিয়া।
উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম কারুকার্য খচিত, ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের মনমুগ্ধকর শৈলীসম্পন্ন মসজিদটি গেদু মিয়া মসজিদ নামেই সুপরিচিত। পু্র্বপুরুষদের নিবাস দিল্লিতে হলেও গেদুমিয়া ত্রিপুরায় এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে। প্রাথমিক জীবনে পেশায় ছিলেন হাতির মাহুত। তারপর গাড়ির ড্রাইভার। চাকরি পেয়ে যান ত্রিপুরার শেষ রাজকীয় শাসক মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের (১৯২৩-১৯৪৭) জিপের ড্রাইভার হিসেবে।
পরশপাথরের ছোঁয়া পেলে পথপার্শে পড়ে থাকা পাথরের নুড়িও কখনও সোনা হয়ে উঠে। আবদুল বারিক খান ওরফে গেদু মিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সহৃদয় রাজন্যের সাহচর্য গেদুমিয়ার জীবনে আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।
সন ১৯৩৯। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ইউরোপ ছাড়িয়ে পুর্ব এশিয়ার দিকে ধাবিত। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ইংরেজদের চাই স্থানে স্থানে ঘাটি বন্দর গড়ে তোলা। আগরতলায় নেই কোনো বিমানবন্দর। সাহচর্য চাইলেন ত্রিপুরাধিপতির। সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য। আশ্বাস দিলেন- বিমানবন্দর হবেই। কিন্তু দায়ভার নেবে কে ? বিষন্ন মহারাজকে বিষন্নতার কারণ জিজ্ঞেস করলেন ড্রাইভার গেদু মিয়া। গাড়ি চালাতে চালাতে আশ্বাস দিলেন মহারাজকে- দায়িত্ব দিলে যথাসময়ে সম্পন্ন করে দিতে পারি বিমানবন্দর তৈরির কাজ।
মহারাজের বিশ্বস্ত এবং নির্ভরশীল অনুচর গেদুমিয়া নির্মাণ ঠিকা পেলেন বিমানবন্দর নির্মাণের। চুক্তি সম্পাদন হলো সাত লাখ টাকার। দেখতে দেখতে তিন বছরের মাথায় প্রস্তুত বিমানবন্দর। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে।
বিল হাতে পেয়ে দেখলেন মুনাফা হয়েছে বিস্তর। হাজার সত্তরের কাছাকাছি। ভেবে দেখলেন ব্যক্তিগত সুখভোগ করে পরিশ্রমের এই আয় উড়িয়ে দিলে ক্ষণস্থায়ি জীবনের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে সবকিছু। এমন কিছু করতে চাইলেন, যা হয় দীর্ঘদিন ধরে ফলদায়ী, জনহিতকর। সিদ্ধান্ত নিলেন স্থাপন করবেন এক সুরম্য মসজিদ। শহরের বুকে। স্থানীয় এবং দুরান্ত থেকে শহরে আগত মুসল্লিরা পরিতৃপ্তির সাথে আদায় করবেন নামাজ। বসে বসে করবেন ঈবাদাত, আধ্যাত্ম সাধনা ।
যোগাড় হলো মাটি। ডেকে আনলেন ঢাকা থেকে জনা তিরিশেক দক্ষ মিস্ত্রি। কাজ করে চললেন তারা অক্লান্ত পরিশ্রমে। অবশেষে ৩ বছরের মাথায় নির্মানকাজ হলো সুসম্পন্ন। মসজিদ নির্মাণে সেই যুগে খরচ হয়েছিল ৬০ হাজার টাকারও অধিক।
সুদর্শন মসজিদটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল আমদানিকৃত সাদা মার্বেল পাথর। বিস্তৃত সবুজ মুক্ত জায়গা রেখে সম্মুখভাগে নির্মাণ করা হয় মিনার, টাওয়ার এবং দরজায় শিল্পকর্ম দ্বারা সমৃদ্ধ মসজিদটি। যা আজও একজন সাধারণ ব্যক্তির অসাধারণ স্থাপত্য প্রীতি, ভক্তি ও ধার্মিকতার সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে শহর আগরতলায়।
মসজিদের সামনে রয়েছে দু’টি কবর। গেদু মিয়া ও তার স্ত্রী রয়েছেন সেখানে সমাহিত ।