ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী

Eastern
4 Min Read
35 Views
4 Min Read

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী

লেখক: মোহাম্মদ বুরহানুদ্দিন কাসেমি
সম্পাদক: ইস্টার্ন ক্রিসেন্ট, মুম্বই

ওয়াকফ আইন ১৯৯৫-এ সাম্প্রতিক কিছু সংশোধন, যা এখন “ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫” নামে পরিচিত, তা ভারতের সাংবিধানিক ও ইসলামি দৃষ্টিকোণে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই আইনে এমন অনেক ধারা রয়েছে যা কেবল অসঙ্গত এবং একতরফা নয়, বরং ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫, ২৫, ২৬ এবং ২৯-এ বর্ণিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।

এই সংশোধনীগুলোর উদ্দেশ্য ওয়াকফ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং মুসলমানদের নিজ ধর্মীয় কার্যাবলীতে স্বাধীনতাকে খর্ব করা—যা অত্যন্ত বিপজ্জনক নজির স্থাপন করে।

সবচেয়ে আপত্তিকর একটি সংশোধনী হলো, এখন কেউ ওয়াকফ তখনই করতে পারবে যদি সে “কমপক্ষে পাঁচ বছর যাবত কার্যকরভাবে মুসলমান” হয়ে থাকে। এই শর্ত ইসলামি শরিয়তের আলোকে একেবারেই ভিত্তিহীন, এবং এটি সংবিধানের ২৫ ও ২৬ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের ধর্ম পালন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম অনুসারে, ওয়াকফ একটি ইবাদত ও সদকা জারিয়ার কাজ, এর জন্য শরিয়তে কোনো ‘পাঁচ বছরের কার্যকর মুসলমান’-এর শর্ত নেই। এই সংশোধনী বিশেষত নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের তাদের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা) ও ১৫ (ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের নিষেধাজ্ঞা) লঙ্ঘন করে।

আরও একটি অসাংবিধানিক সংশোধনী হলো, এখন অ-মুসলিমদের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি সংখ্যালঘুদের দেওয়া সাংবিধানিক অধিকার—অনুচ্ছেদ ২৬ ও ২৯—এর পরিপন্থী। সংবিধান সংখ্যালঘুদের অধিকার দেয়, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই, নিজেদের ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করার। যদি হিন্দুরা মন্দির, খ্রিস্টানরা গির্জা এবং শিখরা গুরদোয়ারা পরিচালনা করতে পারে, তাহলে মুসলমানদের এই স্বাধীনতা কেন থাকবে না? এই সংশোধনী স্পষ্টত মুসলমানদের লক্ষ্য করে তৈরি, যা প্রশাসনিক বৈষম্যের জন্ম দেয় এবং ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী।

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী

এই আইনের মাধ্যমে জেলা কালেক্টর ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত, তদন্ত এবং এমনকি বাতিলও করতে পারবেন। এটি সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের এবং মুসলিমদের ধর্মীয় ও দানব্যবস্থাকে দুর্বল করার বৈধ পথ তৈরি করছে। এটি শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করবে—যেগুলো এতিম, দরিদ্র, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রয়োজনে ওয়াকফ করা হয়েছে।

“ব্যবহারের ভিত্তিতে ওয়াকফ” (Waqf by User)-এর ধারণাকে বাতিল করাও এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ, যা এমন বহু সম্পত্তিতে মুসলমানদের ঐতিহ্যগত অধিকার খর্ব করবে, যেগুলো বহু প্রজন্ম ধরে ধর্মীয় ও সামাজিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এখানে একটি গুরুতর প্রশ্ন হলো—“কার্যকরভাবে মুসলমান” হওয়ার সিদ্ধান্ত কে নেবে? এখন কি সরকার শরিয়তের ব্যাখ্যা দেবে? মুসলমানদের ধর্মপরায়ণতা পরিমাপের জন্য কি কোনো স্কেল আবিষ্কার করা হয়েছে? এই চিন্তা ইসলামি দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ ইসলামে কোনো স্তরভিত্তিক বা শ্রেণিভিত্তিক ব্যবস্থা নেই যার মাধ্যমে কাউকে ভালো বা খারাপ মুসলমান বলা যায়। এটি তো কেবল আল্লাহই জানেন যে, কে কতটা সৎ ও ধার্মিক। এই সংশোধনীও সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ—ধর্ম পালনে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বাধীনতা—এর লঙ্ঘন করে।

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ অন্তর্ভুক্ত বহু ধারা কেবল ইসলামি শিক্ষার বিরোধী নয়, বরং সংবিধানিক নীতিমালার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এটি মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত করে, তাদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় বৈষম্যের মুখে ফেলে এবং সরকারের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তিতে বৈধ হস্তক্ষেপের পথ খুলে দেয়।

ইংরেজি মাধ্যমের মারকাজ অনলাইন মাদ্রাসায় ভর্তি চলছে
ইংরেজি মাধ্যমের মারকাজ অনলাইন মাদ্রাসায় ভর্তি চলছে

এই সংশোধনীগুলো শুধু মুসলমানদের নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রত্যাখ্যান করা উচিত—যিনি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন। এটি মৌলিক অধিকার, আইনের সমতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার—যা ভারতের সংবিধানের মূল ভিত্তি—এর লঙ্ঘন। সুপ্রিম কোর্টের উচিত ছিল এই আইনের বিরুদ্ধে নিজ উদ্যোগে আমলে নেওয়া। তবে যেহেতু ইতিমধ্যে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে, আশা করা যায়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের চেতনাকে বজায় রেখে ন্যায়বিচারসম্মত রায় দেবেন।

Share This Article
Leave a Comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Trending News

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী লেখক: মোহাম্মদ…

Eastern

ডিজিটাল ইউয়ানের নীরব উত্থান ও মার্কিন ডলারের আধিপত্যের অবসান

ডিজিটাল ইউয়ানের নীরব উত্থান ও মার্কিন ডলারের আধিপত্যের অবসান লেখক: মোহাম্মদ বুরহানউদ্দীন…

Eastern

দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও আইনি পদক্ষেপের ডাক মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের

দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও আইনি পদক্ষেপের ডাক মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের EC…

Eastern

ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫: এক সাংবিধানিক বিপর্যয়, তবে মুসলিম নেতৃত্ব নিরাশ করেনি

ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫: এক সাংবিধানিক বিপর্যয়, তবে মুসলিম নেতৃত্ব নিরাশ করেনি…

Eastern

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের জীবনাবসান

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের জীবনাবসান EC News Desk দিল্লি ২৬-১২-২০২৪, ভারতের…

Eastern

ভারসোভা বিধায়ক হারুন রশিদ খান এবং নতুন AIMPLB সদস্য ইকবাল চুনাওয়ালাকে MMERC তে সংবর্ধনা

ভারসোভা বিধায়ক হারুন রশিদ খান এবং নতুন AIMPLB সদস্য ইকবাল চুনাওয়ালাকে MMERC…

Eastern

Quick LInks

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা: প্রাণ হারালেন ২৬ জন

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা: প্রাণ হারালেন ২৬ জন EC News Desk: কাশ্মীর…

Eastern

ওয়াকফ আইন ২০২৫ ওয়াকফ সম্পত্তির উপকারের পরিবর্তে ওয়াকফের জন্য হুমকি

ওয়াকফ আইন ২০২৫ ওয়াকফ সম্পত্তির উপকারের পরিবর্তে ওয়াকফের জন্য হুমকি। জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ…

Eastern

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী লেখক: মোহাম্মদ…

Eastern