ক্বাজী মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, এম, এ, এম, এম
হযরত খাদিজা রাঃ এর জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তিনি কি অপরিসীম তার স্বীকার, কি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। দ্বীন ইসলামকে অনুধাবন ও আত্মস্হ করার ক্ষেত্রে তার প্রজ্ঞা দূরদর্শিতা, প্রত্যুৎ পন্নমতিত্ব সমগ্র মানব জাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে আছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সঙ্গে সাদী মোবারকের পর তিনি তার সমস্ত জীবন এবং সমগ্র সম্পদ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খাদিজা (রাঃ) তৎকালীন আরবের সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং বৈশিষ্ট্য ধনশালী মহিলা ছিলেন) মহানবী (সাঃ) কে উৎসর্গ করেছিলেন আর মহানবী (সাঃ) এর নবুওত লাভের পর দ্বীনের খেদমতে তিনি তাঁর ধন প্রাণ উৎসর্গ করেন।
হযরত খাদিজা (রাঃ) ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী প্রথম ব্যক্তি। হযরত খাদিজা (রাঃ) এর মতো প্রতিপ্রাণা নারীর সঙ্গে রাসূল (সাঃ) বিবাহিত জীবন পরম সুখে কাঠতে থাকে। কিন্তু যিনি বিশ্ব মানবের মুক্তির দিশারী হয়ে এসেছেন তিনি তো অভাবে দিন কাটাতে পারেন না। রাসুল (সাঃ) পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু হয় তার মধ্যে এক গভীর অধ্যাত্মিক ভাবান্তরের। এসময় তিনি মক্কা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী “হেরা” নামক নির্জন গিরি গুহায় গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। একাধারে দুই তিন দিন নির্জন বাস শেষে মহানবী (সাঃ) গৃহে ফিরে আসতেন। আবার দুই তিন দিনের মতো খাদ্য পানীয় নিয়ে চলে যেতেন নির্জন বাসে। এক সময় হযরত খাদিজা (রাঃ) যোগ্য সহধর্মিনীর ন্যায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে স্বামীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। যে সত্যের আলোয় মহানবী সাঃ এর হৃদয় আলোকিত হচ্ছিল সে সত্যের হাতছানি যেন তিনি ও অনুভব করেছিলেন।
কোনো এক মহাকল্যাণের আগমন প্রতীক্ষায় তার অন্তর ও হয়ে উঠেছিল অধীর উন্মুখ, তাই মহানবী (সাঃ) এর কাছে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে অসীম ধৈর্য সহকারে পরম একনিষ্ঠতা নিয়ে মহানবী (সাঃ) কে সর্বাত্মক, সহযোগিতা করে যেতে লাগলেন। তার সেই পরম কাঙ্খিত শুভ মুহূর্তটি যখন এলো মহানবী (সাঃ) এর উপর পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হলো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভীত কম্পিত হয়ে এসে হযরত খাদিজার (রাঃ) কাছে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন। তখন খাদিজা (রাঃ) একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন “হে আবুল কাশেম! আপনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না, মানুষের হক নষ্ট করেন না, আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। আল্লাহ নিশ্চয় আপনাকে অপদস্ত করবেন না। বরং এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলেছি আপনি মানব জাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
অতঃপর খাদিজা ওয়ারাক্বা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন এবং তাঁকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা বললেন। ওয়ারাক্বা ছিলেন আসমানী কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলে সুপণ্ডিত। সব শুনে ওয়ারাক্বা বলে উঠলেন, “কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন, মহাপবিত্র ফেরেশতা, মহাপবিত্র ফেরেশতা। আল্লাহর শপথ করে বলেছি, হে খাদিজা! তুমি বিশ্বাস করো, মুহাম্মদের নিকট আল্লাহর মহান দূতই এসেছিলেন, যিনি মুসার নিকট আসতেন বস্তুত মহম্মদ মানবজাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। তিনি যেন অবিচল থাকেন”। অতঃপর খাদিজা গৃহে ফিরে এলেন এবং বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা কালক্ষেপণ না করে আল্লাহতে পূর্ণ বিশ্বাস এবং রাসুলুল্লাহর (সাঃ) নবুয়তকে সত্য বলে সাক্ষ্য দিলেন। এভাবে তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে সত্য-সাক্ষ্য দানকারী প্রথম মুসলিম।
অতঃপর হযরত মুহাম্মদ সাঃ যখন প্রকাশ্য সত্য দ্বীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হলেন তখন চতুর্দিক থেকে মহানবীর (সাঃ) এর উপর নেমে এলো বিপদ, ভয় আশঙ্কা ও লাঞ্ছনার তুফান, কুরাইশরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে মহানবী (সাঃ) এর দ্বীন প্রচারে সর্বাত্মক বাধা সৃষ্টি করতে লাগলো সেই কঠিন কঠোর দিনগুলোতে হযরত খাদিজা (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর একমাত্র সান্তনা দানকারী।
তিনি শুধুমাত্র মহানবী সাঃ এর সঙ্গে একমত ছিলেন না সকল বিপদে সম্ভাব্য সব উপায়ে সাহায্য করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন। যখনই কোন অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হতো মহানবী (সাঃ) মর্মাহত হতেন, খাদিজা (রাঃ) এর কাছে গেলেই আল্লাহর ইচ্ছায় আর তাঁর সমস্ত মনোকষ্ট দূর হয়ে যেত।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রচ্ছন পয়গম্বর রূপটিকে সর্বপ্রথম তিনিই সত্যিকার ভাবে চিনতে পেরেছিলেন। আর তাই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অধ্যাত্মিক ও পয়গম্বর জীবনের বিকাশের পথে তিনি তাঁর যথার্থ সেবিকা ও সঙ্গিনী হতে পেরেছিলেন । স্বীয় মনপ্রাণ ও ধন-সম্পত্তি ইসলামের চরণতলে অকাতরে লুটিয়ে সেদিন এই মহীয়সী মহিলা শিশু ইসলামকে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিষ্ঠায় যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
হযরত খাদিজা ছিলেন স্নেহবৎসল জননী, গৃহকর্মে সুনিপুণা, ইয়াতিম, বিধবা ও দূরস্হ মানবের সাহায্যকারী, আশ্রয়দাত্রী এবং প্রতিপ্রাণ। একবার রসুলে খোদা (সাঃ) কে একখণ্ড তক্তার উপর বসিয়ে গোসল করাচ্ছিলেন। তক্তার নিচে খাদিজা (রাঃ) এর আঙ্গুল আটকে গিয়েছিল আর পায়ের ওই আঙ্গুল কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গোসলের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। অথচ আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) গোসলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে মনে করে তিনি উহ শব্দটিও করেননি। হযরত খাদিজা (রাঃ) এর এই কুরবাণী ছিল প্রকারান্তরে ইসলামের প্রতি ভালোবাসারই নামান্তর।